
কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূল ও প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন রাতের অন্ধকারে গোপন এক আন্তর্জাতিক চোরাচালান নেটওয়ার্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পাঠানো প্রায় ২০ লাখ টাকার চাল, ডাল, তেল, ওষুধ ও সিমেন্ট গোপনে পৌঁছে যায় মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির হাতে। বিনিময়ে ফেরত আসে অন্তত দুই কোটি টাকার ইয়াবা, আইস ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য।
রাতের অন্ধকারে নাফ নদীর জলের উপর দুলতে থাকা জেলেদের নৌকা, রোহিঙ্গা বাহকের হাতছানি, স্থানীয় প্রভাবশালী ও বোট মালিকদের জোটবদ্ধতা- সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে ‘বার্টার-ড্রাগ’ চক্র। সীমান্তের অন্ধকার, সমুদ্রপথের গোপন রুট ও দ্বীপের নির্জন ঘাটের এই অবৈধ বাণিজ্য এখন প্রশাসনের নজরদারি ছাপিয়ে পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য এক বাস্তব হুমকি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই চক্র শুধু মাদক পাচার নয়, তা এখন এক শক্তিশালী নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে, যা দেশের সীমান্ত, উপকূল ও শহরমুখী নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। এই আধুনিক মাদকপাচারের সিন্ডিকেট শুধু কয়েকজন জেলের দখলে নেই। এতে যুক্ত রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী বোটমালিক, সাবেক ইউপি সদস্য, জনপ্রতিনিধি এবং রোহিঙ্গা গডফাদারদের এক সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক। তারা রাতের অন্ধকারে ট্রলার পরিচালনা করে, নারী, শিশু ও রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে বহন ও খালাসে। সন্দেহ এড়াতে সাজানো হয় ‘অপহরণ নাটক’, যা কখনো কখনো বিজিবি বা কোস্টগার্ডের চোখ এড়াতে কাজে লাগে।
সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপে রাতের অন্ধকারে সমুদ্রপথে ট্রলারগুলো অন্ধকারে এগোতে থাকে। প্রতিটি ট্রলারে লুকানো থাকে বাংলাদেশের নিত্যপণ্য। জেলেরা হাতের ইশারায় নির্দেশনা দেয়, ট্রলার থেকে ছোট নৌকায় মাল নামানো হয় এবং সেই ছোট নৌকা নিয়ে রাখাইনের উদ্দেশে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ডাববাড়িয়া পয়েন্ট, ওয়েস্ট বিচ, দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল এবং দ্বীপের উত্তর-পূর্ব কোণ- এই চারটি জায়গা মূল পাচার হটস্পট। রাতের নিঃশব্দে অঙ্গভঙ্গি, ট্রলারের নড়াচড়া, জেলের হাতের ইঙ্গিত- সবই যেন এক গোপন চলচ্চিত্রের দৃশ্য।
স্থানীয় একটি জেলে বলেন, এখানে আলো জ্বালালে কোস্টগার্ডের নজর পড়ে। তাই আমরা ট্রলার ও নৌকা অন্ধকারে চালাই। ট্রলারগুলো স্লিপ করে রাখাইনের কাছে পৌঁছায়, বিনিময়ে ফেরত আসে ইয়াবা ও আইস।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ‘বাংলা মাল’ চক্রের মূলহোতাদের মধ্যে আছেন সেন্টমার্টিন বোট মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ ওরফে ডান্ডা রশিদ, আবুল কাশেমের ছেলে রোহিঙ্গা মোনাফ ওরফে বার্মাইয়া মোনাফ এবং কয়েকজন সাবেক ইউপি সদস্য ও স্থানীয় প্রভাবশালী। শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ এবং সাবরাং এলাকায় মূল হোতাদের মধ্যে রয়েছেন মান্নান, মোয়াজ্জেম হোসেন দানু, ফজল হক এবং দেলোয়ার ডাকাতসহ আরও কয়েকজন।
মিয়ানমারে বসে সিন্ডিকেট পরিচালনা করেন মো. রফিক নামে একজন। ধন্যাবতী এলাকায় অবস্থানরত তিনি নিয়মিত বাংলাদেশে আসেন বিভিন্ন পরিচয়ে। এছাড়া আবুল কালাম, গৌড়া পুতু, জুহুর আহম্মদ, সালেহ আহম্মদ, মিজানসহ একাধিক ব্যক্তি যুক্ত। এই সিন্ডিকেট সীমান্তের অসাধু চক্রকে কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছে।
তথ্য বলছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপে ‘বাংলা মাল’ বিনিময় চক্রের মূলহোতা বোট মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদ ওরফে ডান্ডা রশিদ, আব্দুর রশিদ মেম্বার এবং আবুল কাশেমের ছেলে রোহিঙ্গা মোনাফ ওরফে বার্মাইয়া মোনাফ। সেন্টমার্টিনকেন্দ্রিক মাদক পাচার, চোরাচালানসহ সব ধরনের
অপরাধ-অপকর্মের মূলহোতা এরা। এদের সঙ্গে রয়েছেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত নুরা মিয়ার ছেলে ও সেন্টমার্টিন স্পিডবোট লাইনম্যান জাহাঙ্গীর, ৬ নম্বর ওয়ার্ড পূর্ব পাড়ার আব্দুল হাসেমের ছেলে আজিম উদ্দিন, একই এলাকার মৃত জামাল হোসেনের ছেলে মো. জুবায়ের, মৃত জাফর আহমদের ছেলে নজির আহমেদ, মৃত খলিলুর রহমানের ছেলে আবু তালেব, মৃত জসিম উদ্দিনের ছেলে কামাল হোসেন (পুরাতন রোহিঙ্গা, পরিচয়পত্র আছে), ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য আব্দুর রউফ, পূর্ব পাড়ার মো. নুরুল হকের ছেলে ও বিচকর্মী আশেকুর রহমান, পশ্চিম পাড়ার ১ নম্বর ওয়ার্ডের আবু সামার ছেলে নুরুল ইসলাম, পূর্ব পাড়ার কেফায়েত উল্লাহ, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব পাড়ার মকবুল আহমদের ছেলে মোহাম্মদ আলম।
শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ ও সাবরাং ইউনিয়ন এলাকায় মূলহোতাদের মধ্যে রয়েছেন- সাবরাং ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মান্নান, মুন্ডার ডেইল-আলীর ডেইল এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন দানু ও বাইট্র মার্কিন, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য ফজল হক, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দেলোয়ার ডাকাত। এ ছাড়া নাইট্টং পাড়া করিডোর নিয়ন্ত্রণ করেন গুরা মিয়া, সাবেক কমিশনার শাহআলম, দুলু, মো. ইকবাল ও সরওয়ার। টেকনাফ সদরের তুলাতলী সীমান্তে কাদের ও আব্দুল আজিজ সব ধরনের মাদক কারবারে জড়িত। বাহারছড়া ঘাট, লম্বরী ঘাট, মহেশখালীয়া পাড়া ঘাট ও খুরের মুখ নৌঘাটে সক্রিয় রয়েছে জাফর ওরফে বেজি জাফর, জসিম, মাহমুদুল হক, আজিজুল হক ওরফে আরজু, গোদার বিলের মো. কাশেম ও তার ভাই ছৈয়দ কাশেম এবং সেবর আলম। জিরো পয়েন্ট-সাবরাং বাজার এলাকায় মো. ইসমাইল, একরাম এবং শমসু মেম্বার সক্রিয়। কাটাবনিয়া এলাকায় উমর, ফারুক ও রিদুয়ান। হ্নীলা পূর্ব সিকদারপাড়ার আতর সাইফুল, হ্নীলা ২ নম্বর ওয়ার্ডের বেলাল মেম্বার, কোনারপাড়ার মো. ইদ্রিসের ছেলে রমিজ উদ্দিন, ওয়াব্রাংয়ের মোস্তাক, সেলিম, নওশেদ, ঝিমংখালীর মামুন, কানজরপাড়ার জামাল, কানজরপাড়ার বাদশা মিয়ার ছেলে সাদ্দাম হোসেন, মৌলভীবাজারের বেলাল মেম্বার, চাম বাদশার ছেলে সাদ্দাম, নুরুল হুদা মেম্বার, হোয়াইক্যং নয়া বাজারের শমসু উদ্দিন এবং উনচিপ্রাংয়ের খেলনার দোকানের আনোয়ার।
সেন্টমার্টিন ও শাহপরীর দ্বীপের জেলেরা রাতের অন্ধকারে স্বেচ্ছায় ‘বাংলা মাল’ নিয়ে রাখাইনে যায়। সেখানে গিয়ে কখনো কখনো সাজানো ‘অপহরণ নাটক’ হয়। স্থানীয় গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এভাবে জেলেরা নিরাপদে মাল পৌঁছে দেয় এবং ফেরত আসে কোটি টাকার মাদক।
পরিচয় গোপন রেখে চলতি মাসের ৩ তারিখে সেন্টমার্টিন জেটিঘাটে কথা হয় পাচারচক্রের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মেম্বার আব্দুর রশিদ ওরফে রশিদ মেম্বার।
তিনি জানান, ২০০৯ সাল থেকে তিনি রাখাইনের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছেন। প্রথমদিকে সেখান থেকে তরমুজ এনে ঢাকার সদরঘাটে বিক্রি করতেন। ব্যবসার প্রয়োজনে মাঝেমধ্যে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে রাখাইনে যেতেন, যেখানে তার একটি বড় সিন্ডিকেট রয়েছে বলেও জানান তিনি।
রশিদ মেম্বার বলেন, বাংলা মালের বিনিময়ে মাদক কারবার বেশি লাভজনক। ধরা পড়লেও তেমন লোকসান হয় না। মাত্র ২০ লাখ টাকার মাল নিয়ে গেলে ২ কোটি টাকার মাদক মেলে। তাই পাঁচটা চালানের মধ্যে যদি দুই-তিনটাও ধরা পড়ে, তবু দুই থেকে তিনগুণ লাভ থাকে।
সরাসরি মাদক ব্যবসায় যুক্ত থাকার কথা স্বীকার না করলেও তিনি গর্বের সঙ্গে বলেন, আমার ট্রলার আরাকান আর্মি সম্প্রতি আটবার আটক করেছে। এর মধ্যে চারবার আমি নিজেই বোটে ছিলাম। প্রতিবারই পণ্য আর মাছ রেখে আমাদের ছেড়ে দিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক জেলে বলেন, আমাদের আটকে রাখার ঘটনা ঘটে না। কিন্তু যদি টাকা না দেওয়া হয়, তাহলে আরাকান আর্মি জেলেদের আটক করে থাকে।
বিজিবি ও কোস্টগার্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ মাসে ১৫৮ কোটি ৯৭ লাখ টাকার মাদক ও ২১ লাখ টাকার বাংলাদেশি পণ্য আটক করা হয়েছে। ৭৯ জন পাচারকারী গ্রেপ্তার এবং ৯৯টি মামলা হয়েছে। এ সময়ে ১৩৯ কোটি ৮০ লাখ ৬৬ হাজার টাকার ইয়াবা আটক করা হয়েছে। এছাড়া ২ দশমিক ৯৪৬ কেজি ক্রিস্টাল মেথ (আইস), মদ, বিয়ার, গাঁজা, ফেনসিডিল ও হেরোইনও আটক হয়েছে। বাংলাদেশ কোস্টগার্ডও ৩০৪ গ্রাম স্বর্ণ, ৫১৫ বস্তা ইউরিয়া সার, ১ হাজার ২৮০ বস্তা সিমেন্ট ও ১১৫ টন নিত্যপণ্য আটক করেছে। পাচারের জন্য ব্যবহার করা ১৫টি বোটও জব্দ করা হয়েছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক জান্তা সরকার বিদ্যমান হলেও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির কার্যক্রম সীমান্তে স্বাধীন নয়। খাদ্য, নিত্যপণ্য ও ওষুধের নির্ভরতা তাদেরকে বাংলাদেশি ‘বাংলা মাল’-এর ওপর নির্ভর করিয়ে দিয়েছে। এটি সীমান্তের অসাধু চক্রের জন্য এক বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
মধ্যস্থ থেকে মূল সিন্ডিকেট পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে রয়েছে বিশাল অর্থ এবং মানবসম্পদ। নারী, শিশু, স্থানীয় জেলে ও রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হয় বহন ও খালাসে। বিনিময় প্রক্রিয়ায় ২০ লাখ টাকার নিত্যপণ্যের বিনিময়ে আসে ২ কোটি টাকার মাদক। এটি আধুনিক ‘বার্টার-ড্রাগ ট্রেড’ হিসেবে পরিচিত।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন জানিয়েছেন, আটক জেলেদের উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে চেষ্টা চলছে।
বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, সীমান্তে কঠোর নজরদারি ও নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পাচারকারীদের কোনো ছাড় নেই।

পাঠকের মতামত